মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সোনার গাঁয়ের সোনালি দিন

  • মোঃ আবু ইউসুফ
  • আপডেট এর সময় ০৯:১০:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪
  • ১৪৭ কত জন দেখেছেন
খবরটি শেয়ার করুন

নরম দুর্বা ঘাসে মোড়ানো গ্রামের মেঠোপথে নাঙ্গা পায়ে দাবড়িয়ে বেড়ানোর সেই সুখ স্মৃতি মনের গহীনে আজও দোলা দিয়ে যায়। আশ্বিনের শেষে ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে মুক্তার মতো কুয়াশাজড়ানো গুল্মলতাগুলো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে আমাকে। শহরের ইট সিমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে একাকিত্বে আকুল করে তোলে শৈশবে ফেলে আসা সাঁঝের বেলায় নীড়ে ফেরা ছোড়ই পাখিদের কিচিরমিচিরের মিষ্টি সূর।
বারবার ফিরে যেতে মন চায় সবুজ শ্যামল সোনার গাঁয়ে, যে গাঁয়ের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা ছোট্ট নদী, বর্ষা এলেই যার বুকে ভেসে বেড়ােেতা কোঁষা, ডিঙি আর মালবোঝাই দাঁড়টানা নৌকা। নানা আগাছার ফাঁকে ভেসে বেড়াতো, বোয়াল, শোল, গোলসা, দলবেঁধে দুরন্তবেগে চাপিলা মাছের ছুটে চলা। কিনার ঘেঁষে থাকা, বাইলা, গলদা চিংড়ি ছোট ছোট নানা জাতের মাছ টেঁটা আর ঠেলা জালে শিকার করা। ভাদ্রের খরতাপে ব্যাকুল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে বেড়াতো দুরন্তপনার দল। বাজি ধরে এপাড় থেকে ওপাড়ে সাঁতরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, ডুব দিয়ে ঝিনুক আনতে গিয়ে টেংরা মাছের কাঁটা বিঁধে বিষের ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠা, ক্লান্ত শেষে কাড়াকাড়ি করে তুলে আনা শাপলা ফুল দিয়ে মোরগ ফুল বানিয়ে খেলায় মেতে ওঠা।
চোখে ভেসে উঠে হেমন্তের শেষে শীতের আগমনে বাড়ির উঠুনে মিষ্টি রোদে বসে, থকথকে বসা মাছের তরকারির জোল দিয়ে ঝরঝরে ঠাণ্ডা ভাত খাওয়া। ছোট ভাই বোনদের বিয়ারিং এর তিন চাকার গাড়ি আর সুপারির খোলে বসিয়ে টেনে নেয়ার আনন্দ মুহূর্তগুলো। যা আর কখনোই ফিরে আসবেনা।
বিমোহিত করে তোলে শেষ রাতে মা চাচিদের ঢেঁকিতে ধান ভাঙানোর কটমট শব্দ, মাটির পাতিলে গরম বালুতে গাল ফুলিয়ে মুড়ি ভাজা। নবান্নের গরম গরম পিঠাপুলির সাথে শীতের সকালে মায়ের হাতের খেজুর রসের রসালো সিন্নি, ফেরিওয়ালার মিঠাইয়ে ভাজা রসালো জিলাপি, মায়ের পুরনো স্যান্ডেল, ঘরে থাকা তেলের বোতল দিয়ে হাওয়াই মিঠাই আর কটকটি খাওয়া। ভাদ্রে গাছ পাকা তালের পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণ যেন আজও নাকে লেগে আছে। কলাপাতায় কচি আম খেতের পাকা টমেটো, কলার থোড়ের সাথে কাঁচামরিচ দিয়ে বানানো ভর্তার টক ঝালের স্বাদটি কোনোদিনই ভোলার নয়।
দুপুরের খাবার শেষে ঘরে ঘরে শীতল পাটিতে গা এলিয়ে রেডিওতে দেশ বিদেশের খবর শোনা ছিলো খাবার হজমের মূল উপাদান! আর দিনের পড়ন্ত বেলা, বিকেলে সূর্য ডুবা পর্যন্ত বাড়ির উঠুনে ছোটদের মালাঠোলা, কানামাচি, বউচি, ডাঙুলি, দড়িলাপ খেলা, মা চাচিদের একে অপরের মাথায় উঁকুন খুঁজতে খুঁজতে নানা গল্পের আসর জমানো। ফসল কাটা মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি খেলায় নিজেকে মাতিয়ে রাখা। দিন শেষে মায়ের বকুনি বাবার শাসনের ভয়ে জড়সড় হয়ে মাথা নুইয়ে ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে কেরোসিনের কুপি বাতির লাল আলোয়, জোরে শব্দ করে পড়া শুরু করে বাবা মায়ের রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা! পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাদের অবস্থান দেখে শব্দ করে পড়ার গতি কমানো বাড়ানোর কৌশল রপ্ত করা। পড়ার টেবিলে ছোটরা এসে ফিসফিসিয়ে বাবার শাসনের ভয় দেখিয়ে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার স্মৃতিগুলো চুম্বকের মতো এখনো আকর্ষিত করে। ঘুমের বিছানায় গেলে মাথার উপর ঘোরা ফ্যানের দিকে তাকালে মনে পড়ে, মায়ের হাতে তাল পাখার ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে মাথায় আদুরে হাতে সিঁথি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার সুখ স্মৃতি।
কুলখানির বড় মেজবানে ছোট বড় ভেদাভেদ ভুলে হোগলা পাতার মাদুলে খেতে বসে মাটির সানকিতে ভাতের নিচে গোস্তের টুকরো লুকিয়ে দ্বিতীয়বার চেয়ে নেয়া, খাবার শেষে কদু, শসা, নারকেল শাঁসের সাথে আমসত্ত্বের মিঠুরি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা। অনেকেই লুকিয়ে রাখা পলিতে করে কিছু গোস্তের টুকরো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া ছিলো নিয়মের মতো।
এছাড়া বিয়ে বাড়িতে রঙিন কাগজ কেটে কলা গাছের গেইট সাজিয়ে খোঁড়া গর্তে চেয়ারের এক পায়া রেখে নতুন দুলাকে বসতে দেয়া, বিয়ের আসরে দুলার নতুন জুতা সরিয়ে পর্দার আড়াল থেকে শালা শালীদের সুই দিয়ে খোঁচা দেয়া। খাবারের আগে হাত ধুইয়ে দিয়ে শরবত, হাতে বানানো নানা ধরনের পিঠাপুলি দিয়ে নতুন মেহমানদের আপ্পায়ন করা, কেউ কেউ সেই পিঠাপুলি রুমালে বেঁধে সাথে হাতপাখা, পানির গ্লাস লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া। গল্প হয়ে থাকবে পানির জগ হাতে নিয়ে খাবারের ফাঁকে হেঁটে হেঁটে পানি খাওয়ানো, খাবার শেষে হাত ধুইয়ে দিয়ে গামছায় হাত মুছে দেয়া। কবুল বলার আগে মা চাচিকে জড়িয়ে ধরে মেয়েদের পুপিয়ে কান্নার শব্দ! বিয়ে শেষে আন্তর ঘরে নানা শ্লোকে নতুন দুলাকে নাজেহাল করে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে টাকা আদায়, শীতল পাটি উল্টো বিছিয়ে বোকা বানিয়ে মজা লুটা, আস্ত শুকনো সুপারি ভাঙতে দিয়ে দাঁতের পরীক্ষা করা, অন্যদের সাথে নতুন বউকে বসিয়ে কাপড়ে ঢেকে দিয়ে নিজের বউকে বাছাই করা, সবার সামনে দুজন মিলে দুরাকাত শোকরানার নামাজ পড়া, শেষে কুপি বাতি নিভিয়ে দুলা এবং তার সাথে থাকা মেহমানদের সামনে খেতে দেয়া মুরগির রোস্ট (সাগোরানা) নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় বাড়িজুড়ে হৈচৈ পড়ার শব্দ। পরের দিন নতুন জামাইকে পুকুরে ফেলে কাদা মাখামাখিতে মেতে ওঠা। বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন বউ পালকিতে চড়ার আগে হাউমাউ করে জ্ঞান হারানোর কান্নায় উপস্থিত সবার চোখ ভিজিয়ে দেয়ার দৃশ্য মনে হলে এখনো চোখ ভিজে উঠে!
ফিরে পেতে মন চায় সেই শৈশব! বর্ষা শেষে শুকিয়ে যাওয়া মাঠে সোনার ফসল ফলাতে বাবা ভোরের আলো-আঁধারে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নিয়ে খালি মুখে বেরিয়ে যেতেন ফসলের মাঠে, রোদ উঠলে মায়ের তৈরি করা রুটি ভাজি পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে খেতের আইলে গিয়ে বাবাকে ডেকে দুজন মিলে আইলে বসে সকালের নাস্তা খাওয়ার মজাটাই ছিলো আলাদা। রক্তঝরা কষ্টের, বীজ বোনা খেতের পরিচর্যায়, জমিতে ফলানো সরিষার হলদে রঙ, ঝুলে থাকা সোনালি ধানের পাকা ছড়া, বুক চিতিয়ে থাকা সূর্যমুখী ফুল, হেলুন, কলই, গম, কাউন, কালোজিরা ধানের বাম্পার ফলনে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠা সেই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।
শহুরে বিষাক্ত বাতাস যখন বিষিয়ে তোলে তখন মন চায় আবারও ফিরে যাই আমার সেই সোনার গাঁয় যেখান ফাগুনের ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছের শুকনো পাতা ঝরিয়ে পায়ের নিচে মর্মর ধ্বণির সূর, কৃষ্ণ চূড়ার ডালে ফুটে ওঠা আগুনের ফুলকিতে হলদে পাখির মিশে যাওয়া, শিমুলের ডালে রক্তলাল ফুলের সাথে জোড়া শালিক ঝাঁকের মেল বন্ধন! ভোরের আজানে ঘুম ভেঙে কায়দা, কোরআন বুকে জড়িয়ে মক্তবের পথ ধরা, আবারো দল বেঁধে সবুজ সোনালি ফসলী খেতের আইল ধরে হেলেদুলে পাঠশালায় যেতে। শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাসকে করে তুলি হৈ-হুল্লোড় আর চিৎকার চেচামেচিতে বজ্রপাতের বজ্রধ্বণি! শিক্ষা গুরুর জালি বেত কিংবা মুলি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে হাতের তালুতে কষকষে বাড়িগুলো ঝিম খিঁচে হজম করা এখনো শিহরণ জাগায়।
যেতে মন চায় শৈশব কৈশর কাটানো সোনার গাঁয়, যেখানে বৈশাখী ঝড়ে কানপাটা বজ্রপাতে কচুরিপানা মোড়ানো পুকুর থেকে উঠে আসা কৈ,শিং, শোল মাছগুলো ডুলা খলিতে ভরে বাড়ি ফিরি….
আবারো পেতে চাই এপাড়া থেকে ওপাড়ার বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছোট খালের উপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো দুরু দুরু বুকে পার হয়ে প্রিয় সহপাঠীর বাড়িতে ঘরের কোণে টক বরই গাছ থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে পেকে থকথকে হয়ে যাওয়া বরই পেড়ে লবণ মরিচে মিশিয়ে খাওয়া, হাটবারে রাস্তার পাশে ৮ আনায় বিক্রি করা নারকেলের শলাকায় থরথরে সাজানো আলুর দম, খেত থেকে তুলে আনা কচকচে খিরাই, শসা, টং দোকানে চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার স্বাদ।
হাটবারে বাজারের গলিতে টুল বিছিয়ে নরসুন্দরের ২ টাকায় এবড়ো থেবড়ো চুল কাটার কথা কি ভুলা যায়। বাবার কিনে দেয়া এক ছটাক সরিষার তেল, তিন পোয়া বোতলে কেরসিন, ৫০ টাকা কেজি দরের গরুর তাজা গোশত, ৫ টাকা ভাগার মলা আর পুঁটি মাছ, গোয়াদা পাতায় ২ টাকার মোটা লবণ, দুই টুকরো নোনতা ইলিশ নিয়ে ব্যাগ ভর্তি তাজা সবজি পিঠে তুলে আটানার রঙিন বুট কিনে খেতে খেতে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে উঠুনে দাঁড়িয়ে মা বলে চিৎকার করা আর সন্ধ্যা নামতেই হাঁস মুরগি খোঁয়াড়ে ধরার জন্য মায়ের তৈ তৈ শব্দ আজ গল্পের মতো ……

ট্যাগঃ

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

সোনার গাঁয়ের সোনালি দিন

আপডেট এর সময় ০৯:১০:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ মার্চ ২০২৪
খবরটি শেয়ার করুন

নরম দুর্বা ঘাসে মোড়ানো গ্রামের মেঠোপথে নাঙ্গা পায়ে দাবড়িয়ে বেড়ানোর সেই সুখ স্মৃতি মনের গহীনে আজও দোলা দিয়ে যায়। আশ্বিনের শেষে ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে মুক্তার মতো কুয়াশাজড়ানো গুল্মলতাগুলো আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে আমাকে। শহরের ইট সিমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে একাকিত্বে আকুল করে তোলে শৈশবে ফেলে আসা সাঁঝের বেলায় নীড়ে ফেরা ছোড়ই পাখিদের কিচিরমিচিরের মিষ্টি সূর।
বারবার ফিরে যেতে মন চায় সবুজ শ্যামল সোনার গাঁয়ে, যে গাঁয়ের পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা ছোট্ট নদী, বর্ষা এলেই যার বুকে ভেসে বেড়ােেতা কোঁষা, ডিঙি আর মালবোঝাই দাঁড়টানা নৌকা। নানা আগাছার ফাঁকে ভেসে বেড়াতো, বোয়াল, শোল, গোলসা, দলবেঁধে দুরন্তবেগে চাপিলা মাছের ছুটে চলা। কিনার ঘেঁষে থাকা, বাইলা, গলদা চিংড়ি ছোট ছোট নানা জাতের মাছ টেঁটা আর ঠেলা জালে শিকার করা। ভাদ্রের খরতাপে ব্যাকুল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে বেড়াতো দুরন্তপনার দল। বাজি ধরে এপাড় থেকে ওপাড়ে সাঁতরে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, ডুব দিয়ে ঝিনুক আনতে গিয়ে টেংরা মাছের কাঁটা বিঁধে বিষের ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠা, ক্লান্ত শেষে কাড়াকাড়ি করে তুলে আনা শাপলা ফুল দিয়ে মোরগ ফুল বানিয়ে খেলায় মেতে ওঠা।
চোখে ভেসে উঠে হেমন্তের শেষে শীতের আগমনে বাড়ির উঠুনে মিষ্টি রোদে বসে, থকথকে বসা মাছের তরকারির জোল দিয়ে ঝরঝরে ঠাণ্ডা ভাত খাওয়া। ছোট ভাই বোনদের বিয়ারিং এর তিন চাকার গাড়ি আর সুপারির খোলে বসিয়ে টেনে নেয়ার আনন্দ মুহূর্তগুলো। যা আর কখনোই ফিরে আসবেনা।
বিমোহিত করে তোলে শেষ রাতে মা চাচিদের ঢেঁকিতে ধান ভাঙানোর কটমট শব্দ, মাটির পাতিলে গরম বালুতে গাল ফুলিয়ে মুড়ি ভাজা। নবান্নের গরম গরম পিঠাপুলির সাথে শীতের সকালে মায়ের হাতের খেজুর রসের রসালো সিন্নি, ফেরিওয়ালার মিঠাইয়ে ভাজা রসালো জিলাপি, মায়ের পুরনো স্যান্ডেল, ঘরে থাকা তেলের বোতল দিয়ে হাওয়াই মিঠাই আর কটকটি খাওয়া। ভাদ্রে গাছ পাকা তালের পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণ যেন আজও নাকে লেগে আছে। কলাপাতায় কচি আম খেতের পাকা টমেটো, কলার থোড়ের সাথে কাঁচামরিচ দিয়ে বানানো ভর্তার টক ঝালের স্বাদটি কোনোদিনই ভোলার নয়।
দুপুরের খাবার শেষে ঘরে ঘরে শীতল পাটিতে গা এলিয়ে রেডিওতে দেশ বিদেশের খবর শোনা ছিলো খাবার হজমের মূল উপাদান! আর দিনের পড়ন্ত বেলা, বিকেলে সূর্য ডুবা পর্যন্ত বাড়ির উঠুনে ছোটদের মালাঠোলা, কানামাচি, বউচি, ডাঙুলি, দড়িলাপ খেলা, মা চাচিদের একে অপরের মাথায় উঁকুন খুঁজতে খুঁজতে নানা গল্পের আসর জমানো। ফসল কাটা মাঠে ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি খেলায় নিজেকে মাতিয়ে রাখা। দিন শেষে মায়ের বকুনি বাবার শাসনের ভয়ে জড়সড় হয়ে মাথা নুইয়ে ঘরে ফিরে পড়ার টেবিলে কেরোসিনের কুপি বাতির লাল আলোয়, জোরে শব্দ করে পড়া শুরু করে বাবা মায়ের রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা! পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাদের অবস্থান দেখে শব্দ করে পড়ার গতি কমানো বাড়ানোর কৌশল রপ্ত করা। পড়ার টেবিলে ছোটরা এসে ফিসফিসিয়ে বাবার শাসনের ভয় দেখিয়ে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়ার স্মৃতিগুলো চুম্বকের মতো এখনো আকর্ষিত করে। ঘুমের বিছানায় গেলে মাথার উপর ঘোরা ফ্যানের দিকে তাকালে মনে পড়ে, মায়ের হাতে তাল পাখার ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে মাথায় আদুরে হাতে সিঁথি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার সুখ স্মৃতি।
কুলখানির বড় মেজবানে ছোট বড় ভেদাভেদ ভুলে হোগলা পাতার মাদুলে খেতে বসে মাটির সানকিতে ভাতের নিচে গোস্তের টুকরো লুকিয়ে দ্বিতীয়বার চেয়ে নেয়া, খাবার শেষে কদু, শসা, নারকেল শাঁসের সাথে আমসত্ত্বের মিঠুরি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা। অনেকেই লুকিয়ে রাখা পলিতে করে কিছু গোস্তের টুকরো বাড়িতে নিয়ে যাওয়া ছিলো নিয়মের মতো।
এছাড়া বিয়ে বাড়িতে রঙিন কাগজ কেটে কলা গাছের গেইট সাজিয়ে খোঁড়া গর্তে চেয়ারের এক পায়া রেখে নতুন দুলাকে বসতে দেয়া, বিয়ের আসরে দুলার নতুন জুতা সরিয়ে পর্দার আড়াল থেকে শালা শালীদের সুই দিয়ে খোঁচা দেয়া। খাবারের আগে হাত ধুইয়ে দিয়ে শরবত, হাতে বানানো নানা ধরনের পিঠাপুলি দিয়ে নতুন মেহমানদের আপ্পায়ন করা, কেউ কেউ সেই পিঠাপুলি রুমালে বেঁধে সাথে হাতপাখা, পানির গ্লাস লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া। গল্প হয়ে থাকবে পানির জগ হাতে নিয়ে খাবারের ফাঁকে হেঁটে হেঁটে পানি খাওয়ানো, খাবার শেষে হাত ধুইয়ে দিয়ে গামছায় হাত মুছে দেয়া। কবুল বলার আগে মা চাচিকে জড়িয়ে ধরে মেয়েদের পুপিয়ে কান্নার শব্দ! বিয়ে শেষে আন্তর ঘরে নানা শ্লোকে নতুন দুলাকে নাজেহাল করে ঘরে ঢুকতে না দিয়ে টাকা আদায়, শীতল পাটি উল্টো বিছিয়ে বোকা বানিয়ে মজা লুটা, আস্ত শুকনো সুপারি ভাঙতে দিয়ে দাঁতের পরীক্ষা করা, অন্যদের সাথে নতুন বউকে বসিয়ে কাপড়ে ঢেকে দিয়ে নিজের বউকে বাছাই করা, সবার সামনে দুজন মিলে দুরাকাত শোকরানার নামাজ পড়া, শেষে কুপি বাতি নিভিয়ে দুলা এবং তার সাথে থাকা মেহমানদের সামনে খেতে দেয়া মুরগির রোস্ট (সাগোরানা) নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় বাড়িজুড়ে হৈচৈ পড়ার শব্দ। পরের দিন নতুন জামাইকে পুকুরে ফেলে কাদা মাখামাখিতে মেতে ওঠা। বাবার বাড়ি ছেড়ে নতুন বউ পালকিতে চড়ার আগে হাউমাউ করে জ্ঞান হারানোর কান্নায় উপস্থিত সবার চোখ ভিজিয়ে দেয়ার দৃশ্য মনে হলে এখনো চোখ ভিজে উঠে!
ফিরে পেতে মন চায় সেই শৈশব! বর্ষা শেষে শুকিয়ে যাওয়া মাঠে সোনার ফসল ফলাতে বাবা ভোরের আলো-আঁধারে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নিয়ে খালি মুখে বেরিয়ে যেতেন ফসলের মাঠে, রোদ উঠলে মায়ের তৈরি করা রুটি ভাজি পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে খেতের আইলে গিয়ে বাবাকে ডেকে দুজন মিলে আইলে বসে সকালের নাস্তা খাওয়ার মজাটাই ছিলো আলাদা। রক্তঝরা কষ্টের, বীজ বোনা খেতের পরিচর্যায়, জমিতে ফলানো সরিষার হলদে রঙ, ঝুলে থাকা সোনালি ধানের পাকা ছড়া, বুক চিতিয়ে থাকা সূর্যমুখী ফুল, হেলুন, কলই, গম, কাউন, কালোজিরা ধানের বাম্পার ফলনে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠা সেই প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।
শহুরে বিষাক্ত বাতাস যখন বিষিয়ে তোলে তখন মন চায় আবারও ফিরে যাই আমার সেই সোনার গাঁয় যেখান ফাগুনের ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছের শুকনো পাতা ঝরিয়ে পায়ের নিচে মর্মর ধ্বণির সূর, কৃষ্ণ চূড়ার ডালে ফুটে ওঠা আগুনের ফুলকিতে হলদে পাখির মিশে যাওয়া, শিমুলের ডালে রক্তলাল ফুলের সাথে জোড়া শালিক ঝাঁকের মেল বন্ধন! ভোরের আজানে ঘুম ভেঙে কায়দা, কোরআন বুকে জড়িয়ে মক্তবের পথ ধরা, আবারো দল বেঁধে সবুজ সোনালি ফসলী খেতের আইল ধরে হেলেদুলে পাঠশালায় যেতে। শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে ক্লাসকে করে তুলি হৈ-হুল্লোড় আর চিৎকার চেচামেচিতে বজ্রপাতের বজ্রধ্বণি! শিক্ষা গুরুর জালি বেত কিংবা মুলি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে হাতের তালুতে কষকষে বাড়িগুলো ঝিম খিঁচে হজম করা এখনো শিহরণ জাগায়।
যেতে মন চায় শৈশব কৈশর কাটানো সোনার গাঁয়, যেখানে বৈশাখী ঝড়ে কানপাটা বজ্রপাতে কচুরিপানা মোড়ানো পুকুর থেকে উঠে আসা কৈ,শিং, শোল মাছগুলো ডুলা খলিতে ভরে বাড়ি ফিরি….
আবারো পেতে চাই এপাড়া থেকে ওপাড়ার বুক চিরে বয়ে যাওয়া ছোট খালের উপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো দুরু দুরু বুকে পার হয়ে প্রিয় সহপাঠীর বাড়িতে ঘরের কোণে টক বরই গাছ থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে পেকে থকথকে হয়ে যাওয়া বরই পেড়ে লবণ মরিচে মিশিয়ে খাওয়া, হাটবারে রাস্তার পাশে ৮ আনায় বিক্রি করা নারকেলের শলাকায় থরথরে সাজানো আলুর দম, খেত থেকে তুলে আনা কচকচে খিরাই, শসা, টং দোকানে চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার স্বাদ।
হাটবারে বাজারের গলিতে টুল বিছিয়ে নরসুন্দরের ২ টাকায় এবড়ো থেবড়ো চুল কাটার কথা কি ভুলা যায়। বাবার কিনে দেয়া এক ছটাক সরিষার তেল, তিন পোয়া বোতলে কেরসিন, ৫০ টাকা কেজি দরের গরুর তাজা গোশত, ৫ টাকা ভাগার মলা আর পুঁটি মাছ, গোয়াদা পাতায় ২ টাকার মোটা লবণ, দুই টুকরো নোনতা ইলিশ নিয়ে ব্যাগ ভর্তি তাজা সবজি পিঠে তুলে আটানার রঙিন বুট কিনে খেতে খেতে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে উঠুনে দাঁড়িয়ে মা বলে চিৎকার করা আর সন্ধ্যা নামতেই হাঁস মুরগি খোঁয়াড়ে ধরার জন্য মায়ের তৈ তৈ শব্দ আজ গল্পের মতো ……