সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাকসামের হিরু-হুমায়ুনকে গুমের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম

  • আবু ইউসুফ
  • আপডেট এর সময় ০৭:৪৯:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ১৪৬ কত জন দেখেছেন
খবরটি শেয়ার করুন

তাজুলের ত্রাসের রাজত্ব পর্ব-১
দক্ষিণ কুমিল্লার দুই সিংহপুরুষ হিসাবে খ্যাত লাকসাম উপজেলা বিএনপি ও লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সভাপতি, লাকসাম বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির পারভেজকে গুম করার মাধ্যমে কুমিল্লা -৯ লাকসাম-মনোহরগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
বিরোধীদের দমন করতে তার ভয়ংকর দমন-পীড়ন হার মানায় একসময়ের আলোচিত ফেনীর জয়নাল হাজারিকে। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের সায়েস্তা করতে নিজের শ্যালক মহব্বত আলীকে দিয়ে লাকসামে তৈরি করেন আয়নাঘরের আদলে ভয়ংকর টর্চার সেল। যেখানে বিরোধীদের ধরে এনে হাত পা চোখ বেঁধে দিনের পর দিন অমানসিক নির্যাতন করা হতো।
এছাড়া গড়ে তোলেন, চাঁদাবাজ, দখলদার এবং আগ্রাসী পেটুয়া বাহিনী। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর দখল চাঁদাবাজির কারণে তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন তাজুল ইসলাম, লাকসামের রাজনীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো, গড়ে তোলা এসব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায় তাজুল ইসলাম ক্ষমতার দাপটে লাকসামে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের শতকোটি টাকার জায়গা লোক দেখানো নিলামের মাধ্যমে দখল করে নেন। তার শ্যালক মহব্বত আলীকে দিয়ে দখল করান সরকারী পরিত্যক্ত জায়গাগুলো, এছাড়া রেলওয়ে জংশনে সরকারি মার্কেটে নির্মাণ করে বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। স্থানী সূত্রে জানা যায় শ্যালক মহব্বত আলী, যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম হিরাসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে, পরিবহন, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ এলাকার সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। এসব অন্যায় অপকর্ম আওয়ামী লীগের তৃণমূল এবং স্থানীয় জনগণের তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। কারণ তাজুল ইসলাম ছিলেন মায়া দয়াহীন কসাইয়ের মতো।
এছাড়া তাজুল ইসলাম লাকসাম ছাড়াও নিজের জন্মভূমি মনোহরগঞ্জ উপজেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভাতিজা আমিরকে দিয়ে গড়ে তোলেন আরেক ভয়ংকর বাহিনী। যাদের একমাত্র কাজ ছিলো, মাদক, জমি দখল, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায়সহসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন। তাজুল ইসলাম এতই ভয়ংকর ছিলেন, তার অনিয়ম নিয়ে কথা বললে নিজের দলীয় নেতাকর্মীদেরও সায়েস্তা করে এলাকা ছাড়া করেছেন। তার হাতে বিরোধী দলীয় হাজার হাজার নেতাকর্মী ছাড়াও নিজের দলের শত শত কর্মীও হয়েছেন নির্যাতিত।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলেন, তাজুল ইসলাম এমপি হওয়ার পরেই দলীয় সব দায়িত্ব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বখাটে কর্মীদের নেতা বানিয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে এখানকার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তার এমন আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষ যখন ফুঁসে ওঠতে যাবে, তখনি সে নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে। লাকসাম মনোহরগঞ্জে ত্রাস সৃষ্টি করতে প্রথমেই টার্গেট করেন লাকসামের সিংহপুরুষ নামে খ্যাত সাইফুল ইসলাম হিরু, হুমায়ুন কবির পারভেজকে। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর এই দুই নেতা আহত নেতাকর্মীদের দেখতে কুমিল্লা যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। স্থানীয়রা বলেন বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতা নিখোঁজ পরবর্তীতে গুমের সাথে তাজুল ইসলাম জড়িত।
জানা যায় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী উত্তাল আন্দোলনের সহিংসতায় গুরুতর আহত কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখতে ওইদিন সন্ধ্যার পর লাকসামের জনপ্রিয় এই দুই বিএনপি নেতা তাদের প্রতিবেশী জসিম নামের অন্য এক বিএনপি নেতাকে সাথে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যোগে লাকসাম পৌর এলাকাধীন নিজবাড়ী থেকে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ওইদিন সারাদেশে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীজোটের হরতাল কর্মসূচি থাকার কারণে তারা কুমিল্লা যাওয়ার জন্য বাহন হিসাবে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেন। তারা দু’জন লাকসাম থেকে বের হওয়ার পরপরই তাদেরকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের পিছু নেয় তৎকালীন র‌্যাবের বিতর্কিত এবং পদচ্যুত কর্মকর্তা, বর্তমানে কারাঅন্তরীণ তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি বিশেষ টিম। 
হিরু-হুমায়ুনকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি লাকসামের কিছুটা উত্তরে আলীশ্বর বাজার নামক স্থানে পৌঁছালে হিরু-হুমায়ুনের ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে বিতর্কিত তৎকালীন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের ওইটিম। অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে ড্রাইভারকে বেধড়ক মারধর করে হিরু-হুমায়ুন এবং জসিমকে র‌্যাবের গাড়িতে তুলে নেয় তারেক সাইদ। ওই সময়ে আলীশ্বর বাজারে অবস্থানরত প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের মতে র‌্যাবের গাড়িতে হিরু-হুমায়ুনকে জোরপূর্বক তোলার সময় তাদের দু’জনকে এলোপাতাড়ি ব্যাপক মারধর করে র‌্যাব সদস্যরা। 
তারেক সাইদের নেতৃত্বাধীন র‌্যাব বাহিনী হিরু-হুমায়ুন এবং জসিমকে র‌্যাবের কালোগ্লাস বেষ্টিত গাড়িতে তুলে নিয়ে জেলা সদর কুমিল্লার দিকে চলে যায়। কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় গিয়ে অন্য একটি কালোগ্লাস বেষ্টিত মাইক্রোবাসে শুধু হিরু-হুমায়ুনকে তুলে দেয় তারেক সাইদ। ওই গাড়িটি তখন হিরু-হুমায়ুনকে নিয়ে ঢাকার দিকে চলে যায়। জসিমকে তারেক সাইদের ব্যবহৃত র‌্যাবের গাড়িতেই রাখা হয়।
পরবর্তীতে জসিমকে র‌্যাব হেফাজতে রেখে ওইদিন রাত (২৭ নভেম্বর-২০১৩) ৮টার পর তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের ওইটিম পুনরায় লাকসাম এসে সাইফুল ইসলাম হিরুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার মিলে হানা দেয়। ওই সময় ওই মিলে হিরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকেসহ মিল কর্মচারীদের প্রচন্ড মারধর করে মিলের ক্যাশে থাকা প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যায় তারেক সাইদের নেতৃত্বাধীন র‌্যাব বাহিনী। ভাঙচুর করা হয় মিলের অফিস কক্ষের চেয়ারটেবিলসহ সকল আসবাবপত্র। মিলের হিসাবরক্ষণ কর্মচারী বুদ্ধদেবৎসহ হিরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাবসায়ী সকলকে র‌্যাবের গাড়িতে তুলে নেয় তারেক সাইদ। 
বিভীষিকাময় ভয়াল ওই অপারেশন শেষে ওইরাতের শেষাংশে ভোরবেলায় জসিমসহ হিরুর ফ্লাওয়ার মিল থেকে আটককৃত সকলকে লাকসাম থানায় সোপর্দ করলেও হিরু আর হুমায়ুনের সন্ধান মিলেনি গত প্রায় ৯ বছর। বিতর্কিত র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাইদের এই বীভৎস অপারেশনের বর্ণনা করতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাকসামের একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা যায়, পুরো অপারেশনটিই ছিল পরিকল্পিত। মাগরিবের নামাজের আগেই লাকসাম বাজারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় দোকানপাট বন্ধ করে লাকসাম বাজারের ব্যাবসায়ীরা এবং বাজারে আগত মানুষজন সন্ধ্যার পরপরই নিজেদের বাড়িঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এই অবস্থায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয় আলোর শহর লাকসাম। 
এমতাবস্থায় জনমনে শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, কি হচ্ছে লাকসামে? বিএনপি নেতাকর্মীরাসহ লাকসামবাসী ওই মুহূর্তে আতঙ্কিত অবস্থায় উদ্বেগ উৎকন্ঠায় থাকলেও তখন পর্যন্তও হিরু-হুমায়ুনের পরিবার, বিএনপি নেতাকর্মী বা লাকসামের সাধারণ মানুষ কেউই জানে না যে, হিরু আর হুমায়ুনকে র‌্যাব বাহিনী গ্রেফতার বা গুম করেছে। লাকসাম বিএনপির জনপ্রিয় এই দুই শীর্ষনেতা হিরু-হুমায়ুন এভাবে গুম হওয়ার পর তাদের সন্ধান ও মুক্তির দাবিতে বিএনপিসহ লাকসামের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন ব্যানারের আন্দোলন করেছে দীর্ঘদিন। পরিবারের সদস্যরা র‌্যাব সহ দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ধরনা দিয়েও হিরু-হুমায়ুনের সন্ধান পাননি। 
তারা কি বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানেন না হিরু-হুমায়ুনের পরিবার সদস্যরা বা স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। পুত্রকে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে হুমায়ুনের পিতা রঙ্গু মিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক আগেই। মাসহ পরিবারের সদস্যরা আজও হুমায়ুনের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন আর দিনরাত কাঁদেন। জীবদ্দশায় হুমায়ুনের পিতা ওই অপারেশনে নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের বিতর্কিত ও পদচ্যুত কর্মকর্তা তারেক সাইদকে বিবাদী করে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলাও করেছেন। যতটুকু জানা যায় মামলার অগগ্রতিও তেমন একটা নেই। ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে পরিবারের সদস্যরা দিনরাত আজও তাদের সন্ধান আর মুক্তির দাবিতে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ সাধারণ মানুষ মনে করেন লাকসাম-মনোহরগঞ্জে কেউ যেন তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস না পায়, সেজন্যই তাজুল ইসলাম তাদেরকে গুম করে এই দুই উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়। গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাজুল ইসলামও পালিয়ে যান, তবে অনেকের ধারণা তাজুল ইসলাম দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। তাকে ধরে শাস্তির দাবি জানান লাকসাম মনোহরগঞ্জের নির্যাতিত জনগণ।

ট্যাগঃ

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

লাকসামের হিরু-হুমায়ুনকে গুমের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম

আপডেট এর সময় ০৭:৪৯:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
খবরটি শেয়ার করুন

তাজুলের ত্রাসের রাজত্ব পর্ব-১
দক্ষিণ কুমিল্লার দুই সিংহপুরুষ হিসাবে খ্যাত লাকসাম উপজেলা বিএনপি ও লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু এবং লাকসাম পৌরসভা বিএনপির সভাপতি, লাকসাম বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির পারভেজকে গুম করার মাধ্যমে কুমিল্লা -৯ লাকসাম-মনোহরগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।
বিরোধীদের দমন করতে তার ভয়ংকর দমন-পীড়ন হার মানায় একসময়ের আলোচিত ফেনীর জয়নাল হাজারিকে। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের সায়েস্তা করতে নিজের শ্যালক মহব্বত আলীকে দিয়ে লাকসামে তৈরি করেন আয়নাঘরের আদলে ভয়ংকর টর্চার সেল। যেখানে বিরোধীদের ধরে এনে হাত পা চোখ বেঁধে দিনের পর দিন অমানসিক নির্যাতন করা হতো।
এছাড়া গড়ে তোলেন, চাঁদাবাজ, দখলদার এবং আগ্রাসী পেটুয়া বাহিনী। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর দখল চাঁদাবাজির কারণে তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন তাজুল ইসলাম, লাকসামের রাজনীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো, গড়ে তোলা এসব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায় তাজুল ইসলাম ক্ষমতার দাপটে লাকসামে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের শতকোটি টাকার জায়গা লোক দেখানো নিলামের মাধ্যমে দখল করে নেন। তার শ্যালক মহব্বত আলীকে দিয়ে দখল করান সরকারী পরিত্যক্ত জায়গাগুলো, এছাড়া রেলওয়ে জংশনে সরকারি মার্কেটে নির্মাণ করে বরাদ্দের নামে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। স্থানী সূত্রে জানা যায় শ্যালক মহব্বত আলী, যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম হিরাসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে, পরিবহন, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ এলাকার সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হতো। এসব অন্যায় অপকর্ম আওয়ামী লীগের তৃণমূল এবং স্থানীয় জনগণের তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। কারণ তাজুল ইসলাম ছিলেন মায়া দয়াহীন কসাইয়ের মতো।
এছাড়া তাজুল ইসলাম লাকসাম ছাড়াও নিজের জন্মভূমি মনোহরগঞ্জ উপজেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভাতিজা আমিরকে দিয়ে গড়ে তোলেন আরেক ভয়ংকর বাহিনী। যাদের একমাত্র কাজ ছিলো, মাদক, জমি দখল, চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায়সহসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন। তাজুল ইসলাম এতই ভয়ংকর ছিলেন, তার অনিয়ম নিয়ে কথা বললে নিজের দলীয় নেতাকর্মীদেরও সায়েস্তা করে এলাকা ছাড়া করেছেন। তার হাতে বিরোধী দলীয় হাজার হাজার নেতাকর্মী ছাড়াও নিজের দলের শত শত কর্মীও হয়েছেন নির্যাতিত।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলেন, তাজুল ইসলাম এমপি হওয়ার পরেই দলীয় সব দায়িত্ব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগের বখাটে কর্মীদের নেতা বানিয়ে দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোনঠাসা করে এখানকার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। তার এমন আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে মানুষ যখন ফুঁসে ওঠতে যাবে, তখনি সে নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে। লাকসাম মনোহরগঞ্জে ত্রাস সৃষ্টি করতে প্রথমেই টার্গেট করেন লাকসামের সিংহপুরুষ নামে খ্যাত সাইফুল ইসলাম হিরু, হুমায়ুন কবির পারভেজকে। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর এই দুই নেতা আহত নেতাকর্মীদের দেখতে কুমিল্লা যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। স্থানীয়রা বলেন বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতা নিখোঁজ পরবর্তীতে গুমের সাথে তাজুল ইসলাম জড়িত।
জানা যায় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী উত্তাল আন্দোলনের সহিংসতায় গুরুতর আহত কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখতে ওইদিন সন্ধ্যার পর লাকসামের জনপ্রিয় এই দুই বিএনপি নেতা তাদের প্রতিবেশী জসিম নামের অন্য এক বিএনপি নেতাকে সাথে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যোগে লাকসাম পৌর এলাকাধীন নিজবাড়ী থেকে কুমিল্লার একটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ওইদিন সারাদেশে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীজোটের হরতাল কর্মসূচি থাকার কারণে তারা কুমিল্লা যাওয়ার জন্য বাহন হিসাবে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেন। তারা দু’জন লাকসাম থেকে বের হওয়ার পরপরই তাদেরকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের পিছু নেয় তৎকালীন র‌্যাবের বিতর্কিত এবং পদচ্যুত কর্মকর্তা, বর্তমানে কারাঅন্তরীণ তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি বিশেষ টিম। 
হিরু-হুমায়ুনকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি লাকসামের কিছুটা উত্তরে আলীশ্বর বাজার নামক স্থানে পৌঁছালে হিরু-হুমায়ুনের ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে বিতর্কিত তৎকালীন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের ওইটিম। অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করে ড্রাইভারকে বেধড়ক মারধর করে হিরু-হুমায়ুন এবং জসিমকে র‌্যাবের গাড়িতে তুলে নেয় তারেক সাইদ। ওই সময়ে আলীশ্বর বাজারে অবস্থানরত প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের মতে র‌্যাবের গাড়িতে হিরু-হুমায়ুনকে জোরপূর্বক তোলার সময় তাদের দু’জনকে এলোপাতাড়ি ব্যাপক মারধর করে র‌্যাব সদস্যরা। 
তারেক সাইদের নেতৃত্বাধীন র‌্যাব বাহিনী হিরু-হুমায়ুন এবং জসিমকে র‌্যাবের কালোগ্লাস বেষ্টিত গাড়িতে তুলে নিয়ে জেলা সদর কুমিল্লার দিকে চলে যায়। কুমিল্লা পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় গিয়ে অন্য একটি কালোগ্লাস বেষ্টিত মাইক্রোবাসে শুধু হিরু-হুমায়ুনকে তুলে দেয় তারেক সাইদ। ওই গাড়িটি তখন হিরু-হুমায়ুনকে নিয়ে ঢাকার দিকে চলে যায়। জসিমকে তারেক সাইদের ব্যবহৃত র‌্যাবের গাড়িতেই রাখা হয়।
পরবর্তীতে জসিমকে র‌্যাব হেফাজতে রেখে ওইদিন রাত (২৭ নভেম্বর-২০১৩) ৮টার পর তারেক সাইদের নেতৃত্বে র‌্যাবের ওইটিম পুনরায় লাকসাম এসে সাইফুল ইসলাম হিরুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার মিলে হানা দেয়। ওই সময় ওই মিলে হিরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। তাদেরকেসহ মিল কর্মচারীদের প্রচন্ড মারধর করে মিলের ক্যাশে থাকা প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যায় তারেক সাইদের নেতৃত্বাধীন র‌্যাব বাহিনী। ভাঙচুর করা হয় মিলের অফিস কক্ষের চেয়ারটেবিলসহ সকল আসবাবপত্র। মিলের হিসাবরক্ষণ কর্মচারী বুদ্ধদেবৎসহ হিরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাবসায়ী সকলকে র‌্যাবের গাড়িতে তুলে নেয় তারেক সাইদ। 
বিভীষিকাময় ভয়াল ওই অপারেশন শেষে ওইরাতের শেষাংশে ভোরবেলায় জসিমসহ হিরুর ফ্লাওয়ার মিল থেকে আটককৃত সকলকে লাকসাম থানায় সোপর্দ করলেও হিরু আর হুমায়ুনের সন্ধান মিলেনি গত প্রায় ৯ বছর। বিতর্কিত র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাইদের এই বীভৎস অপারেশনের বর্ণনা করতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাকসামের একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা যায়, পুরো অপারেশনটিই ছিল পরিকল্পিত। মাগরিবের নামাজের আগেই লাকসাম বাজারের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় দোকানপাট বন্ধ করে লাকসাম বাজারের ব্যাবসায়ীরা এবং বাজারে আগত মানুষজন সন্ধ্যার পরপরই নিজেদের বাড়িঘরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। এই অবস্থায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ভুতুরে নগরীতে পরিণত হয় আলোর শহর লাকসাম। 
এমতাবস্থায় জনমনে শুধু একটাই প্রশ্ন ছিল, কি হচ্ছে লাকসামে? বিএনপি নেতাকর্মীরাসহ লাকসামবাসী ওই মুহূর্তে আতঙ্কিত অবস্থায় উদ্বেগ উৎকন্ঠায় থাকলেও তখন পর্যন্তও হিরু-হুমায়ুনের পরিবার, বিএনপি নেতাকর্মী বা লাকসামের সাধারণ মানুষ কেউই জানে না যে, হিরু আর হুমায়ুনকে র‌্যাব বাহিনী গ্রেফতার বা গুম করেছে। লাকসাম বিএনপির জনপ্রিয় এই দুই শীর্ষনেতা হিরু-হুমায়ুন এভাবে গুম হওয়ার পর তাদের সন্ধান ও মুক্তির দাবিতে বিএনপিসহ লাকসামের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন ব্যানারের আন্দোলন করেছে দীর্ঘদিন। পরিবারের সদস্যরা র‌্যাব সহ দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ধরনা দিয়েও হিরু-হুমায়ুনের সন্ধান পাননি। 
তারা কি বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে তাও জানেন না হিরু-হুমায়ুনের পরিবার সদস্যরা বা স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। পুত্রকে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে হুমায়ুনের পিতা রঙ্গু মিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন অনেক আগেই। মাসহ পরিবারের সদস্যরা আজও হুমায়ুনের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন আর দিনরাত কাঁদেন। জীবদ্দশায় হুমায়ুনের পিতা ওই অপারেশনে নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের বিতর্কিত ও পদচ্যুত কর্মকর্তা তারেক সাইদকে বিবাদী করে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলাও করেছেন। যতটুকু জানা যায় মামলার অগগ্রতিও তেমন একটা নেই। ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে পরিবারের সদস্যরা দিনরাত আজও তাদের সন্ধান আর মুক্তির দাবিতে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাচ্ছেন।
স্থানীয় রাজনীতিবিদসহ সাধারণ মানুষ মনে করেন লাকসাম-মনোহরগঞ্জে কেউ যেন তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস না পায়, সেজন্যই তাজুল ইসলাম তাদেরকে গুম করে এই দুই উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়। গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তাজুল ইসলামও পালিয়ে যান, তবে অনেকের ধারণা তাজুল ইসলাম দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। তাকে ধরে শাস্তির দাবি জানান লাকসাম মনোহরগঞ্জের নির্যাতিত জনগণ।