জিএম আহসান উল্লাহ
* গ্যাস সিলিন্ডার এখন সোনার হরিন
* অনেকে পানির মধ্যে বসবাস করছে
* খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে বিপাকে মানুষ
* বন্যাকবলিত বেশির ভাগ এলাকায় মানবিক বিপর্যয়ে দিনাতিপাত করছে মানুষ
টানা বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে আকস্মিক বন্যায় কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ ঘরবন্দি। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে বাসস্থান, তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। পুরো উপজেলার প্রায় সব সড়ক পানির নিচে। পুকুর-দিঘি থেকে শুরু করে মাছের ঘের ও পোল্ট্রি খামার সব কিছুই প্লাবিত হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ এখন অবর্ণনীয়।
অসহায় অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু দালান ও আশ্রয় কেন্দ্রে। বন্যাকবলিত এই উপজেলায় এক সপ্তাহ ধরে সিলিন্ডার গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে উপজেলার বন্যার্তদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক পরিবার গ্যাসের অভাবে রান্না করতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, সংকটের সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার ১ হাজার ৪০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৫০০থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। স্থানীয় দোকানপাটেও তেমন খাদ্যসামগ্রী নেই, থাকলেও দাম অনেক বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার দরুন সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এসব বিষয়ে তদারকিসহ এ উপজেলাকে দ্রুত দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
রবি ও সোমবার উপজেলার বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা ঘুরে জানা গেছে,বন্যাকবলিত বেশির ভাগ এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অনেকে পানির মধ্যে বসবাস করছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে বিপাকে পড়েছে মানুষ। দুর্গতদের অভিযোগ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। উপজেলার সরকারি হিসাবে প্রায় ৬০-৭০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে ষাটের অধিক। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া হচ্ছে শুকনো খাবারের প্যাকেট। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে শুরু করে কয়েকটি স্থানে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। সেখানকার বানভাসি প্রায় দুই লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের অভিযোগ কুমিল্লা জেলার উপজেলার মধ্যে মনোহরগঞ্জ উপজেলার অবস্থান একটু ভেতরে হওয়ায় এবং বন্যার ভয়াবহতার প্রচার না থাকায় কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসছে না। তারা ত্রাণও পাচ্ছেন না। সোমবার সকালে উপজেলার একাধিক ব্যাক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ করা বাইরের স্বেচ্ছাসেবকরা একদম আসছেন না মনোহরগঞ্জ উপজেলায়। মনোহরগঞ্জ উপজেলা একেবারেই নোয়াখালীর পাশে। মহাসড়ক থেকে দূরের উপজেলা হওয়ায় সেখানে বানভাসিদের কাছে যাচ্ছেন না কেউই। যার কারণে এ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের পানিবন্দি মানুষের মধ্যে হাহাকার বেড়েই চলেছে।
এদিকে উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে মনোহরগঞ্জ বাজার, নাথেরপেটুয়া বাজার, বিপুলাসার বাজার, বাইশগাও বাজার, হাসনাবাদ বাজার, শান্তির বাজার, লক্ষনপুর বাজারসহ ছোট-বড় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে।
যে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও গ্যাস সিলিন্ডারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান থাকবে বলে মনোহরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন জানিয়েছেন।
মৈশাতুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল মান্নান বলেন, সকালে বাজারে গ্যাস কিনতে গিয়ে দেখি প্রতি সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়।বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে।
ওমর ফারুক নামে মনোহরগঞ্জ উপজেলার এ শিক্ষক বলেন, এ উপজেলা আগে থেকেই জলাঞ্চল নামে পরিচিত। এ উপজেলা নিন্মাঞ্চল হওয়ায় পানিতে মানুষ খুবই কষ্ট পাচ্ছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে নৌকা ও স্পিডবোট দরকার। কিন্তু এখানে তেমন কোনো সহায়তা এখনো আসেনি। মানুষ কষ্টে আছে। বন্যার কারণে লাড়কির সংগ্রহ করতে পারছে না। অপরদিকে ঘরের ভেতরে পানি উঠে যাওয়ায় মাটির চুলাতেও রান্না করতে পারছি না। রান্নার জন্য বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার।
উপজেলার খিলা বাজারের ব্যবসায়ী খোরশেদ মিয়া বলেন, যে কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার দোকানে ছিল তা বিক্রি হয়ে গেছে। ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করেও আমরা গ্যাস সিলিন্ডার পাচ্ছিনা। তিনি আরও বলেন অনেকেই একটু বেশি দামে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত আমেনা বেগম বলেন, এখানে রান্না-বান্নার তেমন ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের দেওয়া রান্না খাবার ও মুড়ি-বিস্কুটসহ শুকনো খাবার খেয়ে গত দুদিন পার করছি।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উজালা রানী চাকমা বলেন, উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আজও পানি কিছুটা বেড়েছে। মনোহরগঞ্জ উপজেলায় অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে যেখানে নৌকা ছাড়া যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে নৌকার প্রচুর সংকট রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন একটা মানুষও অভুক্ত না থাকে। তবে আমাদের আরও অনেক সহায়তা দরকার। যা আসছে তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। আমি অনুরোধ করবো সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীরা বানভাসি মানুষের জন্য এগিয়ে আসুন।